এপেন্ডিসাইটিস এর লক্ষণ। এপেন্ডিসাইটিস হলে করনীয়

এপেন্ডিসাইটিস/ অ্যাপেন্ডিক্স কি

এপেন্ডিসাইটিস বা অ্যাপেন্ডিক্স হলো আমাদের পেটের মধ্যে অনেক সময় ব্যথা অনুভূত হয়। এই ব্যথাকে আমরা সাধারণত গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা বলে এড়িয়ে যাই। আসলে সব ব্যথাই গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে হয়না। অনেক সময় ভয়ংকর রোগের আলামত হিসেবে এই ব্যথা দেখা দেয়। এই ব্যথা কেই বলা হয় এপেন্ডিসাইটিস বা অ্যাপেন্ডিক্স এর ব্যথা। আমরা অনেকেই এই অ্যাপেন্ডিক্স এর ব্যথাকে স্বাভাবিকভাবে  বুঝতে দেরি করে ফেলি যার কারণে ঘটতে পারে অনেক বড় বিপদ। আমাদের শরীরে বৃহদন্ত্র নলের মতো ফাঁপা। এই বৃহদন্ত্রের তিনটি অংশের মধ্যে প্রথম অংশটি হচ্ছে সিকাম। এই সিকামের সাথেই  ছোট একটি আঙ্গুলের মত অংশ দেখা যায়। আঙ্গুলের মতো দেখতে অংশটিই হল অ্যাপেন্ডিক্স। এক প্রকারে বলা যায়, অ্যাপেন্ডিক্স হচ্ছে খাদ্যনালী বৃহদন্ত্র অংশের সংযোগস্থলে অবস্থিত আঙ্গুলের মতো দেখতে একটি ছোট থলি। কোন কারনে এ জায়গাতে আঘাত বা সংক্রমণ হলে অ্যাপেন্ডিক্স এর সংক্রমণ হয় ফলে জায়গাটি ফুলে ওঠে ও ব্যাথা অনুভূত হয়। ডাক্তারি পরিভাষায় একে এপেন্ডিসাইটিস বলা হয়। এই অ্যাপেন্ডিসাইটিস হচ্ছে একটি জরুরি অবস্থা যাতে অ্যাপেন্ডিক্স উত্তপ্ত হয় এবং পেটের নিচের ডানদিকে প্রচন্ড ব্যাথা সৃষ্টি করে। এছাড়াও অ্যাপেন্ডিসাইটিস থাকা ব্যক্তিরা অন্যান্য উপসর্গ যেমনঃ বমি, জ্বর, ব্যথা ইত্যাদি অনুভব করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৫% মানুষের প্রাণ যায় এই অ্যাপেন্ডিক্সের সময়মতো চিকিৎসা না হওয়ায়।

Symptoms of appendicitis. Appendicitis should be done.

এপেন্ডিসাইটিস বা অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা কেন হয়

এটি হলো একটা চিকিৎসাগত জরুরি পরিস্থিতি যা যে কোন বয়সের মানুষের ঘটতে পারে। কিন্তু ১০ থেকে ৩০ বছর বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। এপেন্ডিসাইটিস অ্যাপেন্ডিক্স এর একটা বেদনাদায়ক প্রদাহ, যা একটা ছোট আঙ্গুলের মত থলি যা বৃহদন্ত্র থেকে প্রসারিত হয়। অ্যাপেন্ডিক্সের মুখটা অনেক ছোট  যার কারনে মলযুক্ত বস্তু এর  মধ্যে জমা হতে পারে। এ জমে থাকার কারণে জীবাণুগত সংক্রমণ গড়ে তুলতে পারে। এপেন্ডিসাইটিস হলেই সাধারণত অপারেশনের মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব রোগীর অ্যাপেন্ডিক্স কেটে ফেলে দিতে হয়। অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর ব্যাথা সাধারণত নাভির চারপাশে বা উপর থেকে শুরু হয়ে থাকে ও তলপেটে ডানদিকে অংশের ব্যথাটা স্থায়ী হয়। সেটা তীব্রও হালকা দুই রকমেরই হতে পারে। যখন অ্যাপেন্ডিক্স উত্তপ্ত হয়, তখন পেট থেকে ব্যাথা অনুভব করা শুরু হয় ব্যথাটা ধীরে ধীরে তীব্র এবং অবিরত হয়।

এপেন্ডিসাইটিস এর লক্ষণ

অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা কতগুলো লক্ষণ রয়েছে যা নিম্নে দেওয়া হলোঃ

  • নাভির চারপাশ থেকে এই ব্যথা ক্রমশ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
  • এপেন্ডিসাইটিস/অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা হলেই তল পেটের ডান দিকে ব্যথা শুরু হবে। আর এই ব্যথাটা ক্রমশই তল পেটের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
  • তল পেটের ডানদিকে ব্যথাটা স্থায়ী হয়।
  • কিন্তু শুরুর দিকে ব্যথা কম হলেও পরে সেই ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। খাবার খেলেই ব্যথা বেড়ে যায়।
  • বমি বমি ভাব হয় ও বমি হওয়া।
  • অনেক সময় জ্বর ও দেখা দিতে পারে।
  • সেই সাথে ডায়রিয়া হতে পারে।
  • ক্ষুধামন্দা হয়ে থাকে।
  • এপেন্ডিসাইটিস এর উপসর্গগুলি হাঁটা-চলা, তলপেটে চাপ দেওয়া কিংবা কাশতে থাকায় আরও খারাপ হতে পারে।

এপেন্ডিসাইটিস এর চিকিৎসা

এপেন্ডসাইটিস হলে সাধারণত অপারেশনের মাধ্যমে  যত দ্রুত সম্ভব  রোগীর অ্যাপেন্ডিক্স কেটে ফেলে দিতে হয়। অ্যাপেন্ডিক্স অপসারণের এই অপারেশনের নাম অ্যাপেন্ডেকটোমি বা অ্যাপেন্ডিসেকটোমি। এটি কমন একটি অপারেশন। কিছু কিছু সময়ে একটা অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপিও ব্যবহার করা হয়। রোগীর মধ্যে যদি এপেন্ডিসাইটিসের সাধারণ লক্ষণগুলো না থাকে অথবা ব্যথার প্রকৃত কোন কারণ যদি খুঁজে না পাওয়া যায় তখন রোগটি নির্ণয় করার জন্য ডাক্তার আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে। এইসব পরীক্ষার মধ্যে থাকতে পারে রক্ত পরীক্ষা, প্রেগন্যান্সি টেস্ট,  প্রস্রারের পরীক্ষা, আলট্রাসনোগ্রাফি,  সিটি স্ক্যান পরীক্ষা করে থাকে।  এই পরীক্ষাগুলোর মধ্যে প্রথম চারটি পরীক্ষার ফলাফল একদিনের মধ্যেই পাওয়া যায় তবে সিটি স্ক্যান রিপোর্ট পেতে একটু সময় লাগে বেশি। এই রোগের পরবর্তী পদক্ষেপ গুলো হল পরীক্ষাগুলো রিপোর্ট পাওয়ার পরে যদি নিশ্চিতভাবে ধরা না পড়ে তাহলে ডাক্তার ল্যাপারোস্কোপি করানোর পরামর্শ দিয়ে থাকে। এতে এক বা একাধিক ছিদ্র করে একটি নলাকার টেলিস্কোপের ন্যায় যন্ত্র ভেতরে প্রবেশ করে এরপর পেটের  অবস্থা, বিশেষত  এপেনডিক্স ও  পেলভিসের  বিভিন্ন অঙ্গ সরাসরি পর্যবেক্ষণ করে রোগ নির্ণয় করে। এপেন্ডিসাইটিস হয়েছে  এমনটি ধারণা করলে সাধারণত অ্যাপেন্ডিক্স কাটিয়ে ফেলে দেওয়ার পরামর্শ ডাক্তাররা দিয়ে থাকে। পরামর্শের উপর জোর দেওয়ার কারণ হলো অপারেশন না করালে অ্যাপেন্ডিক্স  ফুলতে ফুলতে একসময় ফেটে যায় যখন রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যায়।

এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন খরচ

এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করার জন্য সাধারণত ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ পড়ে থাকে। কিন্তু বেসরকারি মেডিকেলগুলোতে খরচ অনেকটাই বেশি হয়ে থাকে যা ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে যায়।সরকারি  মেডিকেল গুলো অথবা নরমাল যে সমস্ত হসপিটাল রয়েছে সেগুলোতে সাধারণত ১০ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে অপারেশন সম্পন্ন করা যায়। অনেক সময় আবার দেখা যায় ডাক্তারের সঙ্গে এভাবে চুক্তি করা হয় প্রয়োজনে যাবতীয় যে সমস্ত ওষুধগুলো লাগবে সেটা যেন হাসপাতাল কর্তৃক বহন করে  তাহলে খরচ টা আরো কিছু কমে পাওয়া যায়।   তাই অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হবে যদি বাইরে কোন মেডিকেলগুলোতে করানো হয়ে থাকে।

এপেন্ডিসাইটিস এর ঔষধ

এপেন্ডিসাইটিসের ওষুধ সম্পর্কে অনেকেই জানতে চায়। এপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের মাধ্যমে ভালো করা যায় এইটা আমরা সকলেই জেনে আসছি তবে সমস্যা গুরুত্বর না হলে এন্টিবায়োটিক ঔষধের মাধ্যমেও সারিয়ে নেওয়া যায়। এপেন্ডিসাইটিসের অপারেশনের পর ডাক্তার নিজেই আপনকে যে সকল ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন মনে করবেন ঠিক সে সকল ঔষধ এর নাম ডাক্তার প্রসক্রিপশনে লিখে দিবেন। আশা করি এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ওষুধ ডাক্তার ছাড়া নিজে নিজে খাওয়া ঠিক হবে না।

এপেন্ডিসাইটিস এর পরীক্ষা

বিশেষ কিছু লক্ষণের মাধ্যমে বুঝে নেওয়া যায় শরীরে এপেন্ডিসাইটিস বা অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা হচ্ছে কি না। তবে শারীরিক লক্ষণের মাধ্যমে যদি সনাক্ত করা না যায় তাহলে রেডিওগ্রাফিক কিছু পরীক্ষা করে এপেন্ডিসাইটিস নির্ণয় করা যায়। রেডিওগ্রাফিক কিছু পরীক্ষার মধ্যে যেমন সিটি স্ক্যান, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও ল্যাব পরীক্ষা করে এই সমস্যা চিহ্নিত করা যায়।
আল্ট্রাসনোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান  ও ল্যাব টেস্টের মধ্যে সব থেকে কার্যকারী হচ্ছে সিটি স্যান পরীক্ষা যা দিয়ে খুব সহজেই অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা কি না তা নির্ণয় করা যায়।

ছেলেদের এপেন্ডিসাইটিস কোন পাশে হয় / মেয়েদের এপেন্ডিসাইটিস কোন পাশে হয়

ছেলে কিংবা মেয়ে, উভয়ের এপেন্ডিসাইটিস বা অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা একই স্থানে হয়ে থাকে। অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা প্রথমে নাভির একটু উপর থেকে শুরু হয়। তারপর তা ধীরে ধীরে নাভির চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আস্তে আস্তে এই ব্যথা ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে তল পেটের ডান দিকে স্থায়ী হতে থাকে। একটু পর পর এই ব্যথা শুরু করে যা অল্প থেকে তীব্রতর হয়। সেই সাথে বমি বমি ভাব হয়, কিছু কিছু সময় বমি ও হয়ে থাকে। হালকা জ্বর হতে পারে ও সাথে কোষ্ঠকাঠিন্যও হয়ে পারে।

অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা কি না বুঝার উপায়

শারীরিক কিছু লক্ষণের দ্বারা খুব সহজেই অ্যাপেন্ডক্সের ব্যথা কি না তা নির্ণয় করা যায়। অধিকাংশ সময় রোগীর অবস্থা খারাপ হলে তা রেডিওগ্রাফিক কিছু পরীক্ষার মাধ্যমেও নির্ণয় করা যায়। যার মধ্যে সিটি স্ক্যান পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সহজ ও দ্রুত সময়ে এই ব্যথা নির্ণয় করা যায়। পরীক্ষা ছাড়াও যেসকল লক্ষণের উপর ভিত্তি করে এই ব্যথা নির্ণয় করা সম্ভব তা নিচে বর্ণনা করা হলো।
অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা কতগুলো লক্ষণ রয়েছে যা নিম্নে দেওয়া হলোঃ

  • নাভির চারপাশ থেকে এই ব্যথা ক্রমশ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
  • অ্যাপেনডিক্স হলেই তল পেটের ডান দিকে ব্যাথা শুরু হবে। আর এই ব্যাথাটা ক্রমশই তল পেটের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
  • তল পেটের ডানদিকে ব্যথাটা স্থায়ী হয়।
  • কিন্তু শুরুর দিকে ব্যাথা কম হলেও পরে সেই ব্যাথা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। খাবার খেলেই ব্যাথা বেড়ে যায়।
  • বমি বমি ভাব হয় ও বমি হওয়া।
  • অনেক সময় জ্বর ও দেখা দিতে পারে সেই।
  • ডায়রিয়া হতে পারে।
  • ক্ষুধামন্দা হয়ে থাকে।
  • অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর উপসর্গগুলি হাঁটা-চলা, তলপেটে চাপ দেওয়া কিংবা কাশতে থাকায় আরও খারাপ হতে পারে।

এপেন্ডিসাইটিস হলে করণীয়

এপেন্ডিসাইটিস বা অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা হলে সবচেয়ে ভালো হবে অপারেশনের মাধ্যমে অ্যাপেন্ডিক্সটি কেটে ফেলা। অয়াপেন্ডিক্স অপসারনের এই অপারেশনকে বলা হয় অ্যাপেন্ডিসেকটোমি বা অ্যাপেন্ডেকটোমি। অপারেশনের মাধ্যমে অ্যাপেন্ডিক্সটি অপসারণ না করা হলে তা আস্তে আস্তে ফুলতে শুরু করবে এবং একটা সময় তা ফেটে যাবে। যার ফলে রোগী মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় তাই চিকিৎকগণ এটি কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়ে থাকে। যেহেতু এটি মানবদেহে এতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত নয় সেহেতু এটি অপসারনে মানব দেহে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। এটি ছিদ্র হয়ে খাদ্যনালীর ভেতরের বিভিন্ন উপাদান, পরিপাক হয়ে যাওয়া খাবারের অংশ এবং মল বেড়িয়ে পেটের চারদিকে ছড়িয়ে যাবে যার ফলে রোগীর মৃত্যুর ঝুকি অনেক বেড়ে যাবে। তাই এপেন্ডিসাইটিস বা অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা হওয়ার সাথে সাথে তা দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিবায়োটিক ঔষধ খাওয়া এবং অপারেশনের মাধ্যমে তা কেটে ফেলা। অন্যথায় এর প্রভাবে রোগীর মৃত্যুঝুকি বেড়ে যাবে।

এপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের পর করণীয়

অ্যাপেন্ডিক্স ব্যথার অপারেশনের পর রোগী কিছুদিনের মধ্যেই আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে। তবে ওপেন সার্জারি করানো হলে রোগীকে অবশ্যই ৪-৬ সপ্তাহ ভারী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে ডাক্তার রোগীকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকবে। ডাক্তারের পরামর্শগুলো মেনে চলতে হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

খুটিনাটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url