নেটহীন বিশ্বের অভিমুখে

"নেটহীন বিশ্বের অভিমুখে"
-Israfil Mortaza

একদিন খুব ভোরেই হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। উঠেই বালিশের পাশের মোবাইলটা হাতে নিলেন সময় দেখার জন্য। কিন্তু একি! ক্লকের জায়গাটায় দেখলেন কয়েকটা ডট, আর পাশের নেটওয়ার্ক চিহ্নের পাশে ক্রস দেওয়া। ভাবলেন, মোবাইলটায় বোধয় ম্যালফাংশন হচ্ছে। তাই বেড থেকে উঠে বারান্দায় গেলেন নেটওয়ার্কের আশায়। কিন্তু না! এখানেও নেট পাচ্ছেন না। গেলেন পাশের রুমে, বাসার আরেকটি মোবাইল চেক করতে, কী ব্যাপার! তাতেও এই একই অবস্থা।

তড়িঘড়ি করে ছুটলেন টিভির রুমে নেটে কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা এটা জানার জন্য। কিন্তু হায়! টিভি ওপেন হল বটে অথচ সবগুলো চ্যানেল ঝিরঝির করছে। 

ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়লেন! পরিবারের সবাইকে ডেকে এই ব্যাপারগুলো জানালেন, তারাও বিস্মিত হয়ে গেলেন। এর পরেই পাশের ফ্ল্যাটে ছুটলেন, পাশের বাড়ি, পাশের মহল্লা! সবাখানেই তো একই অবস্থা। সেদিন আবার বাসার বাজারের তারিখ ছিল। যাইহোক এইসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে গেলেন একটি সুপারশপে, বাজার করলেন অনেক। ক্যাশ কাউন্টারে আপনার এটিএম কার্ডটি বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু এ কী! কার্ড রিজেক্ট হচ্ছে বারবার, নেট সমস্যা! আশে পাশের সবগুলো মানুষেরও একই সমস্যা। 

তড়িঘড়ি করে ছুটলেন আপনার একাউন্ট বেয়ারার ব্যাংকে। ঢুকতেই গার্ডের চেহারায় এক ফ্যাকাশে ভাব দেখলেন। ভেতরে গিয়ে দেখলেন, মানুষ আর মানুষে ভর্তি। ক্যাশ অফিসার ভল্ট খুলে টাকা নিয়ে বসে আছেন কিন্তু কাউকেই পেমেন্ট করতে পারছেন না। কেন! নেট সমস্যা, সার্ভার ডাউন!

জানলেন, সারা দেশেই একই সমস্যা। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন যখন জানতে পারলেন শুধু আপনার দেশ নয় সারা বিশ্বই আউট অফ নেট, আউট অফ কানেক্টিভিটি।

ফেসবুক বন্ধ, টুইটার, ইউটিউব, হোয়াটসএপ, ইমু সবই বন্ধ। একজন দৌড়ে এসে জানালো, শুধু তাই নয় জিপিএস ডাউন, জলে স্থলে আকাশে নেভিগেশনের সব সিস্টেমই ডাউন।

তাহলে বিমান, জাহাজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কি হবে! সবই স্থবির।

যাইহোক, মানিব্যাগের কিছু নগদ টাকা দিয়ে সেদিনের মত কিছু গ্রোসারি আইটেম কেনাকাটা করে বাসায় ফিরলেন। আর ভাবলেন, আগামীকাল সব ঠিক হয়ে যাবে। 

কিন্তু না! আগামী এক সপ্তাহেও কিছুই ঠিক হল না। যেন আদিমকালের এক অন্ধকার পুরিতে বসবাস করছেন। 

আজকেও আবার কিছু কেনাকাটার জন্য ঘরে জমিয়ে রাখা কিছু নগদ টাকা নিয়ে দোকানে গেলেন সদাইয়ের জন্য। কিন্তু এ কী! দোকানি আর নগদ টাকা নিবেন না। কারণ তিনি এই টাকা রাখবেন কোথায়? আবার এই টাকায় তিনি আর কিছুই নতুন করে কিনতে পারছেন না। এলসি বন্ধ, ইমপোর্টারদের ইমপোর্ট বন্ধ।

সপ্তাহের ব্যবধানেই মিলিয়ন-বিলিয়ন লিকুইড ডলার, টাকা, কারেন্সির অস্তিত্ব হাওয়া! বিজনেন ডাউন, কারন মিলিয়ন বিলিনিয়ারদের সব টাকাই তো বায়বীয়ভাবে জমা ছিল। 

তো, এখন কি করবেন! কি কিনবেন, পরিবারের জন্য খাদ্যের কি ব্যবস্থা! 

মহুর্তেই সব কোটিপতি ফকির! দেখলেন, প্রতিটি অলিগলিতে, মহল্লায় বিশৃঙ্খলার অস্থিরতা বিরাজ করছে। সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্জীব হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এ যেন এক বিশৃঙ্খলপুরি, আদিম সমাজ! 

এরপরেই দেখলেন, আপনার চারপাশ কেমন যেন অচেনা অচেনা লাগছে। মানুষের শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মাইক ব্যবহার করছে স্থানীয়ভাবে। তাদেরকেও অসহায় মনে হচ্ছে। যারা মুহুর্তে মুহুর্তে কেন্দ্রের নির্দেশনা পেত সেল ফোনে, সেটাও এখন হচ্ছে না। তারাও এ অবস্থা কাভারে অভ্যস্থ না। তাদেরকেও দ্বিধাগ্রস্থ মনে হচ্ছে।

এক সপ্তাহ আগের পৃথিবীটা এখনই এত অচেনা আর দূর মনে হবে, সেটা ভেবেই আপনার গা শিহরে উঠছে। বিশ্বায়নের সকল থিওরীই যেন আপনার চোখের সামনে ভেঙ্গে পড়ছে একে একে।

দিনের পর দিন যাচ্ছে। আস্তে আস্তে এই গ্রহের সবকিছুর মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। এই এক অদৃশ্য নেটওয়ার্ক যেমন করে সবকিছুর দূরত্ব কমিয়ে পুরো পৃথিবীটাকে একটি গ্রামে রুপান্তর করেছিল, নেট হীনতায় সেটি যেন এখন আকাশ-পাতাল দূরত্বের সৃষ্টি করছে। 

এখন জানছেন, আমদানি নির্ভর পণ্যগুলোর স্টক ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে আসছে। তাহলে কি হবে জ্বালানি তেলের! কি হবে জ্বালানি তেল নির্ভর ইঞ্জিন-চালিত শক্তিগুলোর! বিশ্ব কি তাহলে ক্রমেই ইঞ্জিনহীনতার দিকে এগুচ্ছে! তাহলে কি বিশ্বকে আবার ফিরে যেতে হবে প্রাণী নির্ভর ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবস্থার দিকে!

নাহ! আর ভাবতে পারছেন না!

এরমধ্যে দেখলেন, মানুষ তাদের ঘরে সঞ্চিত কাগুজে নোট নিয়ে বাজারে বাজারে ঘুরছেন পণ্যের জন্য। কিন্তু কি ব্যাপার! বাজারগুলো খালি হয়ে আছে। সবার কাছেই টাকা আছে কিন্তু পণ্য কই? যা ও দুয়েকজনের কাছে আছে তারাও এই নোট দিয়ে দিবে না।

এরইমাঝে পেলেন এমন এক প্রত্যন্ত গ্রামের লোককে যেকিনা তার জমিনের ফলিত মিষ্টি আলু নিয়ে শহরে আসলেন তার পরিধেয় লুঙ্গি কেনার জন্য। কিন্তু একি! তিনিও টাকা নিবেন না। তিনি লুঙ্গির বদলে আলু দিতে চান। হলও তাই, এক কাপড় ব্যবসায়ী লুঙ্গি দিয়ে আলু নিয়ে নিলেন!

আনমনেই আপনি ভাবা শুরু করলেন; তাহলে কি সেই প্রাচীন বিনিময় প্রথার প্রচলন শুরু হল বলে! 

এটা মনে আসতেই, জীবনধারনের বহু পুরানো প্রথা আপনার মনে উদ্ভাসিত হতে লাগলো। আরও ভয়ংকর আগামীর কথা ভেবে, বাসায় দিলেন এক দৌড়। 

সবাইকে নিয়ে ফিরে চললেন নদীর ধারে গড়ে ওঠা আপনার প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে বিগত দুই যুগেও আপনার পা পড়েনি।

কান্ট্রিসাউডে ফিরেই তো আপনি অবাক! একি! এখানে মানুষের মাঝে অস্থিরতা নেই কেন! সারা পৃথিবী যেখানে অস্থির, তারা সেখানে এত নির্ভার কেন!

উত্তরটা নিজেই পেয়ে গেলেন যখন গ্রাম্য গঞ্জে প্রবেশ করলেন। বাহ! এখানে মানুষ তাদের পণ্যের বিনিয়মে অন্যের পণ্যে ক্রয় করছে। একজন তার চাল দিয়ে অন্যের থেকে সবজি নিচ্ছে।

নির্ভরতা তো তাদের জন্যই! নির্ভার তো তারাই থাকবে, যাদের কৃষি ভূমির সাথে কানেকশন আছে। তারাই তো তাদের বিশ্বাস লালন-পালনে সক্ষম!

এরই মাঝে রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে দূর থেকে মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ভেসে আসা “আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম…” শব্দে আপনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠেই আশস্ত হলেন, যাক! এটা তাহলে স্বপ্ন ছিল। কিন্তু একই সাথে এক অজানা আশংকা আপনাকে পেয়ে বসলো! এটা আগমনী দিনের সংকেত নয়তো!

প্রিয় পাঠক, 

একবার ভেবে দেখেছেন কি যদি পৃথিবীতে কভু এমন পরিস্থিতির সূচনা হয়, আর আমরা যারা শহরে অট্রালিকার মাঝে বিভিন্ন ফ্ল্যাট আর অকৃষি ভূমির মালিক হচ্ছি, আমাদের কি হবে? আমাদের কি হবে, আমরা যারা আমাদের মিলিয়ন-বিলিয়ন উপার্জন আর সঞ্চয় ইলেক্ট্রনিক মানির আকারে বিভিন্ন কারেন্সিতে জমা রাখছি? আমরা কি মিনিটেই ফকির হবো না, এই এক নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ে? তখন কি এই পৃথিবীতে এক বড় অস্থিরতা নেমে আসবে না- যেখানে খাবারের হাহাকার চূড়ান্ত রুপ নিবে! মানুষ দ্বিগবিদিক হন্য হয়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্য ঘুরবে!

আর ঠিক তখন যদি কোন এক মহা ক্যারিশম্যাটিক আগন্তুক খাবার আর পরিধেয় নিয়ে এসে বলে, এসো, যত ইচ্ছা খাবার নাও এবং আমার আনুগত্য কর! আমি তোমাদের দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি দিব, খরা কাটাতে বৃষ্টি দিব।

কি ভেবেছেন? মানুষ তার আনুগত্য মেনে নিবে না? অবশ্যই নিবে। অধিকাংশ মানুষই তার অনুসারী হবে।

তাহলে কী হবে আপনার বিশ্বাসের, আপনার আদর্শের? তাকে লালন করতে পারবেন তো ঐ সময়?

ঐ আগন্তুকের ব্যাপারে সতর্কবাণী গুলো জানছেন কি! নাকি মনে করছেন এইগুলো সবই কল্পকাহিনী আর অতিরঞ্জিত! অথবা ভাবছেন, পৃথিবী এতটাই টেকসই যে এমন বিপর্যয়ের আশংকাই নেই।

তাহলে আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, মায়া সভ্যতা-মিশরের পিরামিড যুগের সময়টাও হয়তো এখনকার চেয়ে আরো টেকসই ছিল। নতুবা তারা এত জ্যামিতিক-মহাকাশীয়-নক্ষত্রীয় হিসাব নিকাশ মেনে এমন রহস্যে ঘেরা স্থাপনাগুলো বানিয়েছিল কিভাবে? যার রহস্য এমন আধুনিক যুগেও আমরা ভেদ করতে পারিনি। অথবা, ইতালির সেই শহরের কথা যেটা একরাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, অথচ তাদের ছিল সুপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা।

হতে পারে না যে এমন অনেক আধুনিক সভ্যতার সমাধি ঘটেছিল কোন এক নিকষ কালো রাতে, কোন এক মহা শক্তির মামুলি ইশারায়! 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

খুটিনাটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url